রমেকের সেই চিকিৎসককে সড়াতে প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট

✒️ নিজস্ব প্রতিবেদক:

by Newsroom

 

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে কার্ডিওলজি বিভাগে স্থাপিত ‘ক্যাথল্যাব’ (কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাবরেটরি) ২০১২ সালে চালু হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালে আবার এর কার্যক্রম চালু করা হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

রমেকে ক্যাথল্যাবের চিকিৎসার সফলতা ৯৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা অভাবনীয় বলে চিকিৎসকরা বলছেন। পুনরায় ক্যাথল্যাব চালু হওয়ায় রংপুরে হৃদরোগীদের চিকিৎসা সেবা চালু হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে হার্টের এনজিওগ্রাম, রক্তনালিতে স্টেন্ট (রিং) বসানো এবং পেসমেকার স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে রমেক হাসপাতালে। এতে হৃদরোগীদের চিকিৎসা ব্যয় যেমন অনেক কমেছে, তেমনি রোগীদের ভোগান্তিও লাঘব হয়েছে।

তবে রংপুর মেডিক্যালের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্যাথল্যাব বিভাগের চিকিৎসকের এমন সফলতায় উত্তরাঞ্চলের হৃদরোগীরা খুশি হলেও টনক নড়েছে মেডিকেলের এক সিন্ডিকেটের।হৃদরোগীরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ায় আর ঢাকা মুখী হচ্ছেন না।এতেই পেটে লাথি পড়েছে সিন্ডিকেটের। সক্রিয় সেই সিন্ডিকেট দুইজন রোগীর স্বজনকে ম্যানেজ করে গত বছরের গত ৩ ডিসেম্বর ডাকযোগে ভুক্তভোগী পরিচয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রিং বাণিজ্য ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দেন হাসপাতালটির পরিচালক বরাবর। একইদিন আতোয়ার হোসেন ও মো. মশিউর রহমান নামে এই দুই অভিযোগকারী দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে সরাসরি ও ডাকযোগে অভিযোগের কপি পাঠান। ৫ ডিসেম্বর বিষয়টি জানাজানি হলে – একটি রিং পরিয়ে তিনটি রিং এর টাকা নেন ডা. মাহাবুবুর রহমান, এই শিরোনামে সংবাদ প্রচার হয় কিছু গণমাধ্যমে। প্রচার হয় এর প্রতিবাদ লিপিও। এরপরই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে রংপুরসহ পুরো দেশে। তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে।

তবে সেই অভিযোগকারীদের অভিযোগপত্রের গড়মিলের সূত্র ধরে বেসরকারি দুইটা চ্যানেল সহ বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। রমেকের সেই ঘটনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় সারাদেশে।

সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুই অভিযোগকারীর মধ্যে একজন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মশিউর রহমান। তাঁর অভিযোগ ও অন্যান্য কাগজ পত্রে দেখা যায়, তিনি যে অভিযোগ পত্র লিখেছেন সেখানে উল্লেখ করেছেন, ডা. মাহবুবুর রহমান হার্টে ব্লকের কথা বললেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে গিয়ে জানতে পারেন তার মায়ের হার্টে কোন ব্লক নেই। অথচ তিনি অভিযোগের তারিখ দিয়েছেন ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪। অর্থাৎ ডাক্তার দেখানোর আগেই তিনি জেনেছেন হার্টে ব্লক না থাকার কথা। ঢাকায় যে ডাক্তার দেখিয়েছেন সেটির কাগজ পত্র দেখাতে চাইলেও তিনি কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। এছাড়া রংপুরে যে ডাক্তারকে দেখিয়েছেন সেই প্রেসক্রিপশনের তারিখ কাটাকাটি।

এসব অসঙ্গতিগুলো নিয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী মশিউর রহমান এক পর্যায়ে বেসরকারি সেই টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে
স্বীকার করেন যে, তাকে দিয়ে এসব অভিযোগ করানো হয়েছে।

এদিকে সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে আসে আরেক অভিযোগকারী আতোয়ার হোসেনও প্রমাণ ছাড়াই ডা. মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টে তিনটি রিং পরানোর নামে একটি রিং পরানোর অভিযোগ তোলেন। প্রকৃত ঘটনা হল, একটি রিং পরানোর পাশাপাশি হার্টের বাম দিকে রক্তনালিতে একটি ড্রাগ কোর্টেট বেলুন লাগানো হয়েছে যার ডকুমেন্টসও রয়েছে। আর এই ভুল অভিযোগকারী আতোয়ারকেও একইভাবে সহযোগিতা করেছেন সেই সিন্ডিকেট।

পরে আরও কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সহ বিভিন্ন প্রিন্ট,অনলাইন মিডিয়ায় সিন্ডিকেট সহ চক্রের আদ্যপান্থ উঠে আসলে সেই সময় অনেকটা আড়ালে চলে যায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই সিন্ডিকেট। আড়ালে চলে গেলেও তিন মাস পর আবারও সেই সিন্ডিকেট সম্প্রতি নতুন করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহাবুবুর রহমানকে হাসপাতাল থেকে সড়াতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে রমেকের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে কিভাবে ষড়যন্ত্র করে রোগীর স্বজনদের দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিল চক্রটি তা চ্যানেল২৪ ও নিউজ২৪ এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে। রংপুরবাসী সহ দেশবাসী সে ঘটনা দেখেছে।

তিনি আরও বলেন, সেই প্রতিবেদন মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর চক্রটি আড়ালে চলে গেলেও তিন মাস পর আবারও আমাকে এখান থেকে বদলি করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

ডা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, কয়েকজনে চিকিৎসক মিলে আমাকে এখান থেকে বদলি করতে এবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তাঁরা এভাবেই হয়তো একটার পর একটা চক্রান্ত করে যাবে আমার বিরুদ্ধে। তবে আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মহাপরিচালক বরাবর ডা. মাহাবুবুর রহমানকে বদলির দাবি করা রমেকের সহকারী অধ্যাপক হাসানুল ইসলাম বলেন, আমি সেই চিঠিতে সিগনেচার করেছি কি না সঠিক মনে নেই।

চিঠিতে সিগনেচার করা রমেকের আরেক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে অন্য চিকিৎসকের চাপে সেই চিঠিতে সিগনেচার করেছি। তবে এটা মিডিয়াতে না আসা ভালো।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, যে কেউ কারও বদলি দাবি করতেই পারে। তবে দাবিটা যুক্তিক কি না সেটা দেখতে হবে।

You may also like

Leave a Comment