ইসলামে তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য তিন মাস ইদ্দত (অপেক্ষার সময়) পালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিধান। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সমাজবিজ্ঞানও এই নিয়মের যৌক্তিকতা নিশ্চিত করেছে। এই নির্দিষ্ট সময় নারীর শারীরিক সুস্থতা, মানসিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১. গর্ভধারণ নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা:
বিজ্ঞান বলছে, তালাকপ্রাপ্তা নারী যদি গর্ভবতী হন, তাহলে তিন মাসের মধ্যে এটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। প্রজনন বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে অন্তত ৮-১২ সপ্তাহ (২-৩ মাস) প্রয়োজন। অনেক সময় প্রথম কয়েক সপ্তাহে গর্ভধারণের লক্ষণ বোঝা যায় না, বিশেষ করে যদি মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়।
ইসলামে শিশুর পিতৃপরিচয় স্পষ্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইদ্দতের সময় নিশ্চিত করে যে, কোনো সন্তান থাকলে তার পিতৃপরিচয় নিয়ে কোনো সামাজিক বা আইনগত সমস্যা হবে না। এটি ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার, সম্পত্তির অধিকার এবং পারিবারিক সম্পর্কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. শারীরিক সুস্থতা ও হরমোনের ভারসাম্য:
গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর শরীরে পুরুষের ডিএনএ বা জেনেটিক উপাদান কিছুদিন পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। নতুন সম্পর্কে যাওয়ার আগে শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।
এছাড়া, তালাকের মানসিক ও শারীরিক চাপ নারীর হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, যার ফলে মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়। ইদ্দত নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
৩. মানসিক ও আবেগগত পুনরুদ্ধার:
তালাক যে কোনো নারীর জন্য একটি মানসিক ধাক্কা। এটি বিষণ্নতা, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং হতাশার কারণ হতে পারে।
তিন মাসের ইদ্দতকাল নারীর জন্য মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের সময় দেয়। এটি তাকে নিজের অনুভূতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
৪. পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা:
তালাকের পর হঠাৎ নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তে রূপ নিতে পারে। তিন মাসের বিরতি নারীর নিজের, পরিবারের এবং সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
ইদ্দতের বিধান সন্দেহ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ করতেও কার্যকর। যদি কোনো নারী তালাকের পরপরই পুনরায় বিয়ে করেন এবং সন্তান জন্ম নেন, তাহলে সামাজিকভাবে পিতৃপরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। এই ধরনের বিভ্রান্তি প্রতিরোধের জন্য ইদ্দতের নিয়ম কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৫. স্বাস্থ্যগত ও নৈতিক কারণ:
ডিভোর্স বা সম্পর্কের সমাপ্তির পর নারীর শরীরে এবং মস্তিষ্কে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে। নতুন সম্পর্কে যাওয়ার আগে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, যা ইদ্দতের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়।
এছাড়া, ইদ্দতের সময় নতুন সম্পর্কের প্রতি ধৈর্য ধারণ করা নৈতিক শিক্ষার অংশ। এটি নারীর সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখতেও ভূমিকা রাখে।
উপসংহার:
তিন মাসের ইদ্দতের বিধান শুধু ধর্মীয় নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিক, স্বাস্থ্যগত, মানসিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত যৌক্তিক। এটি নারীর গর্ভধারণ নির্ধারণ, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও এই নিয়মের যৌক্তিকতা সমর্থন করে, যা ইসলামের বিধানের প্রজ্ঞাকে আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।